তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো

ভালবাসায় গল্পের শুরু (ফেব্রুয়ারী ২০২৩)

অরিত্র রহমান
মোট ভোট ১২ প্রাপ্ত পয়েন্ট ৫.০৮
  • ৮৯


"বনেদী বাড়ির মেয়ে-- বড় মামা চা খেতে খেতে বললেন। আমি অফিস থেকে তখন মাত্র বাসায় ফিরেছি। বসার ঘরের উপর দিয়ে আমার ঘরে যাবার সময় এই কথাটুকু কানে ঢুকল। আমি এক পলক মামার দিকে তাকিয়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে গেলাম। পেছন থেকে যেন শুনলাম, মা ক্ষীণস্বরে আমাকে একবার ডাকল কিন্তু বাবা মাকে থামিয়ে দিল। আমি রুমে ঢুকে জামা কাপড় না ছেড়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। নব ঘুরিয়ে শাওয়ারটা ছেঁড়ে দিলাম। বরফ শীতল পানি যেন মুহূর্তের মধ্যে কাপড় ভেদ করে চামড়ায় কামড় বসাল। চোখ বন্ধ করে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ভিজতে থাকলাম। সত্যি বলতে যেন আশেপাশের বাস্তবতা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে চাইলাম। ধুর। এই বিয়ের যন্ত্রণায় আর টেকা যাচ্ছে না বাড়িতে। মাঝে মাঝে মনে চায় এই সব কিছু ছেঁড়েছুঁড়ে দু'চোখ যেদিকে চায় সেদিকে চলে যাই কিন্তু বিধিবাম। চাইলেই কি আর যাওয়া যায়? চাইলেই কি আর মৃত্যুর আগে জীবন থেকে, বাস্তবতা থেকে কখনও মুক্তি মেলে?

কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সোজা ছাদে চলে গেলাম। পরপর ৪ টা সিগারেট খাবার জন্যই হোক আর ভেজা শরীরে থাকার জন্যই হোক রাগটা একটু কমলো। কদিন পর ৩৪ এ পা দিব। কর্পোরেট লেভেলের ভালো স্যালারির একটা জব করি। বাবা মার এক মাত্র ছেলে। শুধু একটাই সমস্যা- চেইন স্মোকার। যদিও আমার পরিবারে একমাত্র আমিই খাই। আগে তাও খেতাম না। আসলে বাবা মায়ের অবস্থাটা আমি বুঝি। ছেলের বউয়ের মুখ দেখতে তো তাদেরও ইচ্ছা হয়। বিয়ে করার ইচ্ছে মোটেও নেই সেটা তাদের অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছি। বাবা ব্যাপারটা এক রকম মেনেই নিয়েছেন বলতে গেলে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মাকে নিয়ে। উনি এখনও হাল ছাড়তে রাজি নন। এখনও আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, নিয়মিত মেয়ে দেখে যাচ্ছেন, মনে আশা, হয়তো আমার মতামত বদলাবে কখনও। মায়ের ইচ্ছাতেই নিয়মিত নিকট আত্মীয়রা সম্বন্ধ নিয়ে আসছে। এই মেয়ে রাজকন্যা যত দেখতে, ঐ মেয়ের বাবা শিল্পপতি, সেই মেয়ের ভাই মন্ত্রী আরও কত হাবিজাবি। আর আমি মায়ের কান্নাকাটি, শত অনুরোধ ঠেলে সেগুলাকে কোনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছি।

বাবা আমার সিদ্ধান্তকে চুপচাপ মেনে নিলেও মাকে কোন ভাবেই মানানো যাচ্ছে না। একদিন তো এমনও হয়েছে যে, গভীর রাতে মা হটাত আমার রুমে এসে উপস্থিত। দুধের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে আমতা আমতা করছিল।

"কিছু বলবে মা?"

"একবার ডাক্তারের কাছে যাবি নাকি বাবা?”

"ডাক্তারের কাছে কেন? শরীর তো ঠিক ই আছে।-- আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।

মা ইতঃস্তত ভাবে বলল, "না মানে, এই যে হটাত বিয়ে করতে চাচ্ছিস না, কোন সমস্যা নেই তো?"

মা কি বুঝাতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। কিছুক্ষণ তার দিকে

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার পর যখন বুঝতে পারলাম মা আসলে কি বুঝাতে

চাচ্ছে তখন প্রচণ্ড রাগ লাগল।

“আহ মা! কোন সমস্যা নেই আমার আর বিয়ে না করলে কেউ মরে যায় না, যাও ঘুমাতে যাও।"

মা মন খারাপ করে চলে গেল। একটু পর অবশ্য আমারই খারাপ লাগতে লাগল এভাবে রেগে কথা বলার জন্য। মায়ের আর কি দোষ। সে তো আর জানে না মনের সেই পুরনো ক্ষতটা এখনও দগদগে। ঘা শুকিয়ে উঠতে পারে নি। আর সবকিছুর জন্য দায়ি যে, সে কি এসব জানে? কখনও ভাবার অবকাশ পায় এসব নিয়ে এখন?



"পরমা, কেমন আছো তুমি? আমার কথা মনে পড়ে কি? একসময় তো তোমার সবটা জুড়ে একমাত্র আমি ছিলাম, আর এখন? সেই জায়গাটা কি অন্য কাউকে দিয়ে দিয়েছ? হয়তো তাই। কে সে? নিশ্চয়ই তোমার হাসব্যান্ড, তাই না? স্বামী সংসার সামলে খুব শান্তিতে ঘর করছো মনে হয়। আচ্ছা আমার সাথের স্মৃতিগুলো মনে পড়ে কি? আমাদের প্রথম দেখা হওয়া, একে অপরের প্রেমে পড়া, এগুলো কি তোমাকে এখনও আনমনা করে দেয়? শত ব্যস্ততার মাঝে আমার কথা ভেবে কখনও কি তোমার মন বিষণ্ণ হয়ে উঠে? কে জানে?

আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা। পরমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় এক ফ্রেন্ডের বিয়েতে। সেদিন বরের জন্য গেইট ধরে দাঁড়িয়ে ছিল কন্যাপক্ষ। গান না গাইলে আমাদের ভেতরে যেতে দিবে না। কি অদ্‌ভুত আবদার? মেয়ে পক্ষ সব সময় টাকা চায় জানি, এরা তো দেখি গান গাইতে বলে! আর সবার সামনে ছিলে তুমি। তোমার অভিমানি মুখটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন ছেলে পক্ষকে দিয়ে গান গাওয়ানোর আইডিয়াটা তোমারই ছিল, এখন তারা গান না গাইলে মান সম্মান কিছু আর থাকবে না বন্ধুদের সামনে। এটা আমার কল্পনাও হতে পারে। হয়তো তোমাকে দেখে সব গুলিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন। কিন্তু সেই তোমার কথা ভেবেই কিনা আমি লাজ- লজ্জার মাথা খেয়ে সবার সামনে হেঁড়ে গলায় গান ধরেছিলাম। যে ছেলেটা ঠিক মত কথা ই বলে না কারো সাথে সে কিনা সবার সামনে গান ধরল। বাথরুম ছাড়া জীবনে গান না গাওয়া আমি সেদিন চিৎকার করে গান গেয়েছিলাম যতটা না বিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকার জন্য তারচেয়ে বেশি তোমার জন্য, তোমার মান সম্মান বাঁচাবার জন্য। সেই গান শুনেই কি না সবাই হেসে হুটোপুটি। তোমরা হাসতে হাসতে গেইট ধরার কথা ভুলে গেলে আর আমরা সুযোগ পেয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম।

বিয়ে বাড়িতে কিন্তু আমি সুযোগ খুজছিলাম, কিভাবে তোমার সাথে কথা বলা যায়, আর তুমি সেটা বুঝতে পেরে অনেক ভাব নিচ্ছিলে। লুকিয়ে আমি বার বার তাকাচ্ছিলাম তোমার দিকে মাঝে মাঝে চোখে চোখাচোখি হচ্ছিল তোমার আমার। আর তুমি দুষ্ট একটা হাসি দিয়ে এমন ভাব করতে লাগলে যেন হটাৎ চোখ পড়ে গেছে। এখন এসব ভাবলে কেমন হাসি পায়। বিয়ে শেষে তোমার সাথে কথা বলতে না পারার আক্ষেপ বুকে চেপে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলাম দেখি তুমি দাঁড়ানো গেইটের সামনে। আমি আমার সব লজ্জা আর ভাব বিসর্জন দিয়ে তোমার কাছে যেয়ে জিগ্যেস করলাম, "কোথায় যাবেন?""

"বনানী"- একটু ইতস্তত করে বলেছিলে তুমি।

"আমি ও ঐদিকেই যাব, যাবেন আমার সাথে?"

আর তুমিও কেমন! চেনা নেই জানা নেই এমন একটা ছেলের সাথে এক রিকশায় বনানী চলে যেতে রাজি হয়ে গেলে।

"ভালো ই তো গান গাইতে পারেন দেখি, গান শিখেন বুঝি?”- রিকশায় উঠে এটা। বলেই মুচকি মুচকি হাসতে ছিলে তুমি। ভালোই মজা নিচ্ছিলে। "এতো সুন্দর কেন মেয়েটা?"-তোমার পাশে বসে এটা ভাবতে ভাবতে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। কি একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ আমাকে মাতাল করে দিচ্ছিল। তোমার গায়ের গন্ধ ছিল সেটা। চোখ বন্ধ করে এসব ভাবলে মনে হয় এখনও পাচ্ছি সেই গন্ধটা। মনে হয় তুমি যাও নি কোথাও, এই তো, পাশেই আছো, হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবো তোমায়।

সম্পর্কের পরে ও অবশ্য বিয়েবাড়ির সেই ঘটনা নিয়ে অনেক মজা করেছ আমার

সাথে।

ভয় করেনি তোমার? অচেনা একটা ছেলের সাথে যেতে রাজি হয়ে গেলে সেদিন?"

"ধুর! তোমাকে দেখে মনেই হয় নি তুমি খারাপ হতে পারো, আর অমন গান যে গায় সে কি কখনও খারাপ হতে পারে?

তুমি হাসতে হাসতে বলতে। শুনে আমি মন খারাপের ভান করতাম আর তুমি মানুষের দৃষ্টি বাঁচিয়ে আমাকে চুমু খেতে, আমার গালে, কপালে, চিবুকে, ভিজিয়ে দিতে আমার সারা মুখ। মনে পড়ে কি তোমার সেসব? নাকি ইচ্ছে করে ভুলে যাবার ভান কর এখন?"



সেদিন অনেক রাতে বড়মামা খেয়েদেয়ে বাবা মায়ের সাথে গল্প গুজব করে চলে গেলেন। এর মাঝে আমি আর রুম থেকে বের হই নি। মা একবার এসে ডেকে গেল, আমি মাথা ব্যথার কথা বলে এড়িয়ে গেলাম। মামা বুঝলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে গেলেন,

"এই যুগের ছেলে মেয়ে গুলো সব রসাতলে গেছে, বিয়ে করতে চায় না। আমার মেয়েটাও হয়েছে এমন। বিয়ের প্রসঙ্গ তুললেই সামনে থেকে গায়েব হয়ে যায়।" এসব শুনে বাবা মা ও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। তাদের সেই দীর্ঘশ্বাস আমি আমার রুমে বসেও শুনতে পেলাম। সেদিন রাতে বাবা আমার রুমে আসলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বললেন,

"আমি তোকে কখনওই কোন ব্যাপারে জোর করি নি. আজ ও করব না, কিন্তু আমরা যখন থাকব না তখন তোর একা কি হবে সেই চিন্তায় তোর মা দিন দিন আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, আশা করি তার কথাটা তুই একটু ভাববি।"

আমি চুপচাপ শুনলাম, কিছু বললাম না।

-তোর বড় মামার বন্ধুর মেয়ে, তোর মায়ের অনেক পছন্দ হয়েছে, আগামি শুক্রবার বিকালে আমরা যাবো ওদের বাসায়, তোর মামা কথা দিয়ে এসেছে, তুই একটু চিন্তা করে দেখ কি করবি।

আমাকে চুপ থাকতে দেখে বাবা আবার বলল, বাবা হিসেবে ছেলের কাছে এটাই চাওয়া যে শুক্রবারে তুই আমাদের সাথে যাবি।" - এই বলে টেবিলের উপর একটা ছবি রেখে উনি চলে গেলেন।

আমি ছবিটা হাতে নিলাম কিন্তু দেখার আগেই অন্য সব দিনের মত আজও পরমার স্মৃতি আমাকে আঁকড়ে ধরল আর সামনের ছবিটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে গেল। কত গভীর ভালোবাসা ছিল আমাদের, সেটাও ভেঙে গেল। আসলে ভালোবাসা বলতে কি কিছু আছে? নাকি পুরোটাই আবেগ? কামনা? সেরাটোনিনের কারসাজি? তবে কি হাজারবার তোমাকে জড়িয়ে ধরাটা হরমোনের কারসাজি ছিল? আমাদের শত শত চুমোতে কি তবে আবেগ দায়ী ছিল? নাকি অনেকবার ভালোবাসাটা শুধু কামনা ছিল?

ভালোবাসা! হা হা হা! আমি বলতাম, 'লেটস ডু সামথিং নটি" আর তুমি বলতা, কি অসভ্য, লজ্জা নেই তোমার? বলবা, "চল ভালোবাসি"। কি ছেলেমানুষি করতাম দু'জন। তোমার ঐ খানের সেই তিলটার কথা আমার এখনও মনে পড়ে, আমি সুযোগ পেলেই চুমো খেতাম সেখানে আর তুমি লজ্জায় লাল হয়ে যেতে। আমি আসলে তোমার সেই লজ্জা রাঙা চেহারাটা দেখার জন্যই বার বার ক্ষুধার্তের মত চুমো খেতাম সেখানে। মনে পড়ে কি সেসব? তুমি বলতা, ঐ পাগল! গুনে গুনে চুমো খাও কেন? এসবের কি কেউ হিসেব রাখে নাকি?"

'সামনের বিসিএসে আসতে পারে, কতবার তোমার আমার কি হয়েছে? তাই গুনে রাখি।"- আমি গম্ভীর মুখ করে বলতাম।

"দুনিয়াতে এত ভালো মানুষ থাকতে এমন একটা পাগল শেষ পর্যন্ত আমার কপালেই জুটলো?- তুমি আক্ষেপ করে বলতে আর আমি হাসতে হাসতে তোমাকে জড়িয়ে ধরতাম।

এটাকে কি লোকে ভালোবাসা বলবে? আমি কোন মেয়েকে আর বিশ্বাস করতে পারি না, শুধু মাত্র তোমার জন্য। কাউকে দেখলেই মনে হয় প্রতারক, বিশ্বাস ভঙ্গকারী। চাইলেই আমি কারো সাথে জড়িয়ে পড়তে পারতাম কিন্তু জড়াই নি। কারন ভালবাসা, বিয়ে, সংসার এই শব্দগুলোর আলাদা কোন অর্থ নেই এখন আর আমার কাছে। শুধুমাত্র তোমার জন্য।

আর ভাবতে পারলাম না, ছবিটা বালিশের নিচে রেখে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম।


8

শুক্রবার সকাল থেকেই বাসায় কেমন উৎসব উৎসব ভাব চলে আসলো। মিষ্টির দোকান থেকে মায়ের পছন্দমত ৮-১০ জাতের মিষ্টি চলে আসলো বাসায়। বাবা নিজে আমার শার্ট ইস্ত্রি করে দিলেন। কি রঙের টাই পড়ব মা পছন্দ করে দিলেন। বড় মামা, মামি, মামাতো বোন দুপুরের আগেই বাসায় চলে আসলো। আমি চুপচাপ শুধু দেখে যাচ্ছি সব কিছু। মামাতো বোন এসে সেই মেয়েটার ছবি দেখার জন্য লাফালাফি করতে লাগলো। আমি বালিশের নিচ থেকে বের করে তার হাতে দিতেই সে চিৎকার করে সারা বাড়ি জানাতে লাগলো যে আমি বালিশের নিচে ছবি নিয়ে ঘুমাই। শুনে মন চাইল একটা কষে থাপ্পড় লাগাই। ফাজিল কোথাকার! নিজে বিয়ে করছে না আবার আমার বিয়ের জন্য পাগল হয়েছে। ছবিটা তার হাতে দেবার সময় এক পলক তাকিয়েছিলাম আমি, সাদামাটা, মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ের ছবি। কেমন বাচ্চা বাচ্চা একটা ভাব আছে চেহারায়। অবশ্য ছবি দেখে বুঝা যায় না সত্যিকারে দেখতে কেমন!

বিকেলে গাড়িতে চেপে আমরা রওনা হলাম, গন্তব্য বনশ্রী। মামার নির্দেশনা মেনে অনেক অলিগলি ঘুরে শেষে একটা পুরাতন আমলের দোতলা বাড়ির সামনে এসে গাড়ি স্থির হল। মামা গর্বিত গলায় বললেন, বাড়ির চেহারা দেখ, শুধু ধনীই না, রুচিবোধও যে আছে বোঝাই যাচ্ছে। উনার কথা শুনে বাবা মা ও মুগ্ধ চোখে তাকাতে লাগলেন, আমি চুপচাপ বসে আছি, নিজেকে কোরবানির পশু মনে হচ্ছে, শুধু জবাই হওয়া বাকি। কোথাও মেয়ে দেখতে গেলে আমি সুযোগ পেলেই মেয়েকে পরমার কথা বলে দেই. প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা করেছি সব, আর এসব শুনে কোন মেয়েই আর বিয়ের জন্য রাজি হয় না। বাঙালি মেয়েরা সব কিছু মেনে নিলেও যার সাথে তার বিয়ে হবে সেই ছেলে যদি কারো সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভড থাকে তা মেনে নিতে পারে না। এবার ও তাই করবো ঠিক করলাম।

পাড়ি থামতেই বাসার ভেতরে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। উপরে তাকিয়ে দেখি দোতলার জানালায় উৎসাহী জনতার ভিড় আমরা গাড়ি থেকে নামতেই বিশাল পেইট খুলে একজন পাঞ্জাবি পরা বাস্ক লোক বেরিয়ে এসে হাসি মুখে আমাদের সালাম দিলেন। মাথা নিচু স্বরে বললেন, মেয়ের বাবা, আমার বন্ধু – এই বলেই তিনি বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি সালাম দিলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "কেমন আছো বাবা?" "জি, ভালো আছি-আমি হাসি মুখে জবাব দিলাম। সবার সাথে কুশলাদি শেষ করে আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন।

বাড়ির সর্বত্রই আভিজাত্যের ছাপ। বসার ঘরের দেয়ালে নানা রকম নকশাকাটা, নাহ! বাড়ির মানুষদের রুচির প্রসংশা করতেই হয়। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক বললেন, "আমার মেয়ের করা, সবগুলোই।" মনে পড়লো, মা একবার বলেছিল, মেয়ে নাকি আর্কিটেক্ট। কিছুক্ষণ পরই মেয়ের মা মেয়েকে নিয়ে আসলেন। মেয়ে ঘরে ঢুকেই আমাদের সালাম দিল, হাতে করে আমাদের জন্য চায়ের ট্রে নিয়ে এসে টেবিলে রাখল। আমি চোরা চোখে তাকালাম সেদিকে। তার হাত কি একটু কাঁপল ট্রে টা রাখার সময়? আমি যেন দেখলাম মেয়েটা একটু কেঁপে উঠল। "সে কি নার্ভাস?"- মনে মনে ভাবলাম।

বাবা জিজ্ঞেস করল, "কেমন আছো মা?" "জী ভালো।"- মেয়েটা নিচু স্বরে বলল। আমি আবার আড়চোখে তাকালাম। শ্যামলা, মায়াকাড়া একটা মুখ। ছবির চেয়ে বাস্তবেই বেশি ভালো দেখাচ্ছে। কত বয়স হবে? ২৩ কি ২৪! আমার তুলনায় বাচ্চাই বলতে হবে। আমাদের ঘিরে সবাই কথা বলতে লাগল, হাসাহাসি করতে লাগল, শুধু আমি আর ও চুপচাপ। হটাৎ গম্ভীর গলায় বললাম, "আমি একটু একা কথা বলতে চাই ওর সাথে। মুহূর্তের মধ্যে নিশচুপ হয়ে গেল সবাই। মেয়ের বাবার মুখটা একটু গম্ভীর হল, পরক্ষনেই বললেন, "ওদের ছাদে নিয়ে যাও।- মেয়ের মা নিজেই আমাদের ছাদে নিয়ে গেলেন। “তোমরা কথা বল, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।"- বলেই তিনি নিচে নেমে গেলেন।

ওদের বাসার ছাদটা সুন্দর। একদিকে গোলাপের বিশাল ঝাঁড় আর অপরদিকে চেয়ার টেবিল রাখা। আমি ভাবলাম সে চেয়ারে বসবে কিন্তু কিছু না বলে সে এক পাশের রেলিং ধরে দাঁড়ালো। আমি কিভাবে শুরু করব ভাবছি।

"আমাদের বাড়িটা কিন্তু অনেক পুরনো, ছাদ, রেলিং যে কোন সময় ভেঙে পড়তে

পারে।"

আমি চমকে রেলিং থেকে সরে দাঁড়ালাম। সে শব্দ করে হেসে উঠল।

"ভয় পেলেন?"- সে হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকাল। আমি কিছু বললাম না।

আমি ই আসলে আপনার সাথে একা কিছু কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আপনি সেটার সুযোগ করে দিলেন।

আমি চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে আছি।

“বাবা মায়ের আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে। এখন আপনারা হ্যাঁ বলে দিলেই সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু .... এইটুকু বলে সে দূরে উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল।

"তুমি কি কাউকে পছন্দ কর?"- এতক্ষণে আমার মুখ ফুটল।

সে দূরে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, স্কুলে শেষের দিকে, একজনের সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিল। ওই বয়সে সবারই ওরকম কিছু থাকে মনে হয়, ছেলেটা আমাদের পাড়াতেই থাকতো তখন। স্কুলে যেতে আসতে দেখতাম, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত, মাঝে মাঝে চোখে চোখ পড়তো, আস্তে আস্তে সে সাহস পেয়ে আমাকে দুই একটা কাগজ ধরিয়ে দিত হাতে. আমি ও আগ্রহ করে নিতাম, বাসায় এসে লুকিয়ে পড়তাম সেগুলা, অনেক প্রেম ভালবাসার কথা লিখা থাকতো সেখানে। এভাবেই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল।"

এইটুকু বলেই সে চুপ হয়ে গেল। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।

আই এম নট আ ভার্জিন, সেই ছেলের সাথে একদিন । তখন বাচ্চা ছিলাম, বেশি কিছু বুঝতাম না। কিন্তু ওই একদিনই। এরপর আর কিছু হয় নি। ঐ ছেলের সাথেও আর কখনও কথা হয় নি।

আমি বললাম, "আসো চা খাই, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।"

শুরুতেই অনেক কিছু বলে ফেললাম, তাই না? আমি ভাবলাম কোন মতামত দেয়ার আগে আপনার অন্তত সবকিছু জানা থাকা দরকার। কোন কিছু গোপন থেকে একটা সম্পর্ক শুরু হোক, আমি তা চাই না। আচ্ছা আমার নামটা একটু অদ্‌ভুত না?"- এই বলে সে আমার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসল এবং আবার বলতে শুরু করল,

"আপনি চাইলে না বলে দিতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না। আর আপনি যেন কি বলতে চাচ্ছিলেন?

আমি হাসিমুখে বললাম, "তেমন কিছু না, অতসী। আর তোমার নামটা আমার ভালো

লেগেছে, আমার কিছু বলার নেই। চলো নিচে যাই।"

ততক্ষণে নিচে বাবা মা আর মামা মিলে আকদের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলেছে, আমাকে জিগ্যেস না করেই। বাসায় ফিরেই আমি সেদিন মায়ের সাথে রাগ দেখালাম তারিখ ঠিক করে আসার জন্য কিন্তু মা আমাকে পাত্তাই দিলেন না। সে আর বাবা দুজনই অনেক খুশি, মিলে প্ল্যান করতে লাগলেন, শপিং কোথা থেকে করবেন, গহনা কোথা থেকে নিবেন। আমি মহা বিরক্ত হলাম কিন্তু তারা সেটা দেখেও না দেখার ভান করতে লাগলেন।





পরদিন অফিসে মিটিঙে, বস সবার সামনে আমাকে ধমকাতে লাগলো ছোট একটা ভুলের জন্য, ঠিক এই সময় বেরসিকের মত আমার ফোনটা বেজে উঠল। শিট! সাইলেন্ট করতে ভুলে গেছিলাম। অচেনা একটা নাম্বার থেকে ফোন, আমি না ধরে কেটে দিলাম। “তোমার মনোযোগ কোথায় থাকে ইদানিং?”- এই বলে বস দ্বিগুণ উৎসাহে আবার বকতে লাগলেন। আমি চুপচাপ শুনে গেলাম।

অফিস শেষে বাসায় এসে দেখি দুনিয়ার শপিং করা হয়েছে। ডাইনিং এ বাবা মায়ের সাথে দেখা হল। দুজনই খোকাখুকুর মত আচরণ করতে লাগল আমাকে দেখে আমি চুপচাপ রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম। মা আংটি বানাতে যাবে বলে আঙুলের মাপ নেয়ার জন্য দরজা ধাক্কাতে লাগলো, আমি রাগ করে খুললাম না। এই সময়ই ফোনটা বেজে উঠল। সেই দুপুরের অচেনা নাম্বারটা। আমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা কানে দিলাম, হ্যালো!”

“কেমন আছেন? সকালে ফোন দিলাম কেটে দিলেন যে? -

-কে আপনি?”

আমি অতসী। আমার নাম্বার নেই আপনার কাছে? আন্টি তো আমাকে বলল,

আপনি নাকি আমার নাম্বার চেয়েছেন? আর আপনার নাম্বার ও দিয়ে গেল। মায়ের কাজকর্মে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। হুম। নাম্বার সেভ করতে ভুলে গেছিলাম। আর সকালে একটা মিটিতে ছিলাম। কেমন আছ? - মিথ্যে বলে কোন

রকমে কাটালাম।

"আমি ভালো আছি, আচ্ছা আপনি কি খুব ভুলোমনা টাইপ নাকি?

"না তা না, আচ্ছা রাখলাম, মা খেতে ডাকছে, পরে কথা হবে।”- তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ফোন রেখে দিলাম। প্রচণ্ড রেগে মায়ের রুমে গেলাম। নেই, বাসায় কেউই নেই। ফোন দিলাম বাবাকে।

"বউমার শাড়িটা নাকি তোর মায়ের পছন্দ হয় নি, তাই বদলাতে যাচ্ছি, তুই খেয়ে শুয়ে পর। - আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাবাই বলল আগে।

- এটা কালকে ও করা যেত। - এটা বলার আগেই উনি ফোন রেখে দিলেন।




"আমার জীবনে খুব পছন্দের দুটো জিনিস ছিল। প্রথমটা ছিল আমার ভেসপাটা। ১৯৬৭ সালের মডেল। আসলে এটা ছিল আমার দাদা ভাইয়ের। উনি চাকরি জীবনের প্রথম বেতন পেয়ে এটা কিনেছিলেন। আমার বাইক চড়তে শিখা এটাতে চড়েই। ছোটবেলা দাদু নিজে আমাকে ভেসপা চালানো শিখিয়েছিলেন। আমি আজ এটা চালানো শিখাচ্ছি তোকে, বড় হয়ে নিজের পছন্দমত একটা বাইক কিনে নিস। - আমাকে ভেসপাতে উঠিয়ে দিয়ে দাদু এটা বলতেন আর আমি কিছুদুর যেয়েই ধপাস করে পড়ে যেতাম। দাদু মারা যাবার পর ভেসপাটা অনেকদিন গ্যারেজে পড়ে ছিল। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর এটাকে অনেক বছর পর দিনের আলো দেখাই, ঠিক করি, রঙ করাই। সবাই আমার ভেসপা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতো। বাবা পর্যন্ত বলত, "এই বাইক চালাবার বয়সে এটা কি চালাচ্ছিস? চল তোকে একটা বাইক কিনে দেই।" আমি শুনে হাসতাম। ভালোবাসার জিনিসের কোন রঙ, আকার, বয়স থাকে না এটা উনি বুঝতে পারেন নি। ভেসপাতে হয়তো আমাকে অদ্‌ভুত লাগত, হাস্যকর লাগতো কিন্তু আমার ওটাই ভালো লাগতো।

আর দ্বিতীয়টা ছিলে তুমি, পরমা। তোমার কাছে কখনও আমাকে বা আমার ভেসপাটা অদভুত লাগতো না। তুমি টের পেয়েছিলে ভেসপাটার প্রতি আমার, ভালোবাসা, যেমন আমি টের পেতাম আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাও কতটা নিখাদ ছিল। তুমি, আমি আর আমার ভেসপা- এই তিনে মিলে কত পাগলামি করেছি। শীতে কেঁপেছি, গ্রীষ্মের রোদে পুড়েছি বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজেছি। কতটা ভালোবাসা ছিল আমাদের মাঝে। এতো দিনের সম্পর্কে কেউ কখনও কাউকে বিন্দু মাত্র সন্দেহ করি নি। অদ্‌ভুত এক ঘোরের ভেতর ছিলাম দুইজনই যেন তুমি আমি ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব নেই পৃথিবীতে। এতটা ভালোবাসা সম্ভবত আমরা সহা করতে পারি নি। তাই কি এই বিচ্ছেদ? এক নিমিয়ে তুমি আমাকে অস্বীকার করে ফেললে?

মনে পড়ে? একদিন তুমি আমি ক্লাস ফাকি দিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। আসার পথে হটাৎ ভেসপাটা গেল বন্ধ হয়ে। যতই স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করি কোন ফায়দা হয় না। আমি কালিঝুলি মেখে একাবার আর তুমি আমাকে দেখে রাস্তার মাঝেই হিহি করে হাসতে লাগলে। তোমার সেই বিখ্যাত হাসি। আমি তোমার পালেও একটু কালি মাখিয়ে দিয়ে নিজেও হিহি করতে লাগলাম। রাস্তার লোকজন আমাদের নির্ঘাত পাগল ভাবছিল। শেষ পর্যন্ত ভেসপাটা ঠিক করে যখন তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিলাম ঘড়িতে তখন রাত ৯ টা। ভেসপা থেকে নামতেই তোমার মা দেখে ফেলল আমাদের। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে।

"আমার ফ্রেন্ড, ক্লাস শেষ হতে দেরী হয়ে গেছিলো তো আজকে তাই পৌঁছে দিতে আসছে।"- তুমি আমতা আমতা করে বললে। তোমার হতভম্ব অবস্থা দেখে আমার অনেক হাসি পাচ্ছিল সেদিন তাও হাসি চেপে আন্টিকে সালাম দিলাম।

“কোথায় থাকো তুমি?

"জী, এদিকেই, সামনের গলিতে। অকপটে মিথ্যা বলেছিলাম আমি।

'বাসায় যাও। অনেক রাত হয়েছে।

"জী আন্টি - এই বলে আমি ভালোয় ভালোয় কেটে পড়েছিলাম।

পরদিন দেখা হতেই বলেছিলে, মা মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। আজ সকালে খালাকে ফোন দিয়ে বলল ছেলে দেখতে আমার জন্য। আমাকে দেখতেই চুপ হয়ে গেল।

আরে ধুর! টেনশন করো না। ছেলে দেখা মানেই তো না যে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। আমি বোকার মত বুঝ দিয়েছিলাম তোমাকে। তুমি যে সেটা শুনে বেশি ভরসা পাও নি. তোমার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি বাসায় তোমার কথা বলে দিয়েছি সব।"- এর কয়দিন পরই তুমি হুট করে বলেছিলে।

করেছো কি তুমি?"- শুনে আতকে উঠলাম।

“কেন বলবো না কেন? মা অনেক বেশি জ্বালাচ্ছে কয়েকদিন ধরে। না বলে দেয়া ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না অরিত্র।

“ভালো করেছ, এখন কি করবো সেটা বল?-

মা তোমার সাথে দেখা করতে চায়। বাসায় যেতে বলছে একদিন। - সে আমতা

আমতা করে বলল।

"কি?"

"হুম! একদিন আসো বাসায়। তোমার সাথে কথা বললেই দেখবা মা রাজি হয়ে

যাবে। - আমাকে আশ্বস্ত করেছিলে তুমি।

আজ সত্যি বলছি আমার যাবার কোন ইচ্ছাই ছিল না। শুধু তোমার মন রক্ষা করতেই গিয়েছিলাম একদিন তোমাদের বাসায়। কিন্তু তোমার মায়ের মন আমি রক্ষা করতে পারি নি সেদিন। কিভাবেই বা পারব বলো? তখন আমি ছিলাম সদ্য পাশ করে বের হওয়া বেকার এক যুবক, না আছে আমার বাবার অনেক টাকা পয়সা, না আছে আমাদের প্রভাবশালী আত্মীয় স্বজন। এসব ছাড়া কি তোমার মত বিত্তশালী প্রেমিকার পরিবারকে আমি মানাতে পারতাম? তুমি না হয় বোকা ছিলে, আমার মত গাধার প্রেমে পড়েছিলে কিন্তু তোমার বাবা মা তো আর এতো বোকা না যে আমি তাদের সাথে দেখা করলেই বা তোমাকে অনেক ভালবাসি বললেই তারা তোমাকে আমার হাতে তুলে দিবে। আমি কখনই তেমন বাস্তববাদী ছিলাম না কিন্তু আন্টি সেদিন আমাকে রুঢ় বাস্তবতাটা দেখিয়ে দিলেন। আমার যোগ্যতা কতটুকু সেটা বুঝিয়ে দিলেন। আচ্ছা পরমা, আমাদের ভাঙ্গনের শুরুটা কি সেদিন থেকেই? এখান থেকেই কি বিচেচ্ছদটা পরবর্তীতে ডালপালা মেলে বিশাল বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছিল? হয়তোবা!




পরমার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল ৬ বছর ৪ মাস ১৭ দিনের। ১৭ নাকি ২১ দিন? ১৭ তম দিনেই পরমা রাগ করে বলেছিল, "গ্রো আপ অরিত্র, অনেক বয়স হয়েছে তোমার, এমন ইমমেচিউরড বিহেইব করো না। আমাদের বয়সই কত? এখনই বিয়ে করতে হবে কেন?

খেপিয়ে বললাম, বয়স আমার ২৭ হতে চলল, এখন না করলে আর কবে করবো? “মাত্র গ্র্যাজুয়েট হয়েছো, এমবিএ করো, আর এখন যে সেলারি পাও তা দিয়ে দুইজন

বরাবরের মত আমি তার রাগকে পাত্তা না দিয়ে তার চুল ধরে টান দিয়ে তাকে আরও চলতে পারবো? "একটু কষ্ট হবে কিন্তু চলতে পারব না, তা কিন্তু না, ভালোবাসা আছে না? আর কি লাগে? “ভালোবাসা দিয়ে সংসার চালাবা, এটা আমার বাবা মাকে বুঝাতে পারবা? তারা আনবে? “মানবে না কেন জান? তুমি আমি মিলে মানাবো।" - আমি তাকে চুমু খেতে এগিয়ে না, পারি নি, দরকার হলে আবার যাবো আন্টিকে মানাতে।-- কোন পথ না দেখে আমি এটাই বলেছিলাম সেদিন তোমাকে।

যাই। সে আমাকে ঝটকা মেরে দূরে সরিয়ে চলে যেতে যেতে বলে যায়- মজা বন্ধ কর, বাসায় তো গেছো, আমার মাকে মানাতে পেরেছো?

-না, পারি নি, দরকার হলে আবার যাবো আন্টিকে মানাতে।-- কোন পথ না দেখে আমি এটাই বলেছিলাম সেদিন তোমাকে।
এভাবে সম্পর্ক রাখা যায় না অরিত্র, এভাবে আর চলছে না।”- তুমি কেমন অন্যমনস্কের মত বলেছিলে কথাটা।

আমি বরাবরের মত সেদিন ও তোমার রাগকে পাত্তা দেই নি। এটাকে পাত্তা দিতে হবে এমনটা আমার কখনও মাথায়ই আসেনি। পুরো দুনিয়া উল্টে গেলেও তুমি আমাকে ছাড়বে না এই বিশ্বাস আমার ছিল। আর এমন ছোটোখাটো ঝগড়া তো আমাদের সব সময়ই হয়। আমরা রাগ করি, ঝগড়া করি, কিছুক্ষণ কথা বলা বন্ধ কয়দিন দেখা করা বন্ধ, তারপর আবার সব আগের মত দুজন হাসি ঠাট্টা করি, ভালোবাসাবাসি করি, এভাবেই একজন অপরকে ছাড়া থাকতে পারি না, কখনও পারি নি। এভাবেই চলে আসছে সব সময়, গত ৬ বছর ধরে।

কিন্তু সেদিনের ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক ঝগড়া ছিল না, সেটা আমি বুঝতে পারি নি। কিন্তু আমার বোঝা উচিত ছিল। যে তুমি সব সময় চাইতে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে সে হটাত বিয়ের কথা শুনলেই ক্ষেপে যাচ্ছে এটাকে আমার গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল। বুঝতে পারি অনেক দেরিতে। ২১ তম দিনে, সেদিন খুব ভোরে তোমার ফোনটা আসে। মাঝের এই কয়দিন আমাদের আর কথা হয় নি। ভাবলাম, তুমি হয়তো আর থাকতে পারছো না তাই ঝগড়া মিটিয়ে ফেলতে চাচ্ছে। আমি ঘুম ঘুম গলায় ফোন ধরে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, "কি ? এতো সকালে জ্বালাচ্ছ কেন?

“আর কখনও জ্বালাবো না অরিত্র। তোমার গলায় কেমন কান্না কান্না ভাব! আমার ঘুম পুরোপুরি কেটে গেল একথা শুনে।

“কি হয়েছে পরমা? কাঁদছ নাকি? জ্বালাবার কথা তো মজা করে বলেছি।"

"আমি অনেক ভেবে দেখলাম অরিত্র, এভাবে আর চলছে না। আমরা শুধু ঝগড়াই

করি সব সময়, আর কিছু না।"

"কি বলছ এসব? আমি তোমাকে ভালবাসি না? শুধু ঝগড়াই করি?”

হ্যাঁ, তুমি অনেক ইমমেচিউরড। আমাকে বুঝো না একবিন্দু ও। তাই আমি অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আলাদা হয়ে যাব, এভাবে আমি আর পারছি না।"

“পরমা, বুঝার চেষ্টা কর, এতদিনের এতো সব কিছু, তুমি এক মুহূর্তে শেষ করে দিতে

চাচ্ছ?"

“আমি কাল সারারাত ঘুমাইনি । অনেক ভেবে এটা ঠিক করেছি, এতে আমাদের দুইজনেরই ভালো অরিত্র, আমাকে ক্ষমা কর।"- এটা বলেই সে ফোন কেটে দেয়। আমি সাথে সাথেই ফোন ব্যাক করি, কিন্তু না, তার ফোন অফ। আমি বুঝতে পারি না, সে কি মজা করল আমার সাথে?"

বাবার ডাকে হটাৎ ঘুম ভেঙে যায়, "কি রে খাবার টেবিলে ঘুমাচ্ছিস কেন?” ঘরে যেয়ে ঘুমা। আমি টেবিল থেকে মাথা উঠাই। বাস্তবে ফিরে আসি। প্রাক্তনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে গেছি টের পাই নি।

“দেখ তো বাবা, আংটি টা পছন্দ হয় কিনা?” মা আমার দিকে একটা একটা আংটি বাড়িয়ে দেয়। আমার এনগেজমেন্টের আংটি, আমার মায়ের পছন্দ, আমার অপছন্দ হবার কোন কারণই নেই। এই আংটি একদিন অন্য কারো পরার কথা ছিল।

“তোমার পছন্দ হলেই হবে মা আমি আমার রুমে চলে গেলাম।




আমার কথা শুনে কি আপনি আমাকে করুণা করছেন?”- পরদিন রাতে ফোন দিয়েই অতসী এক নিঃশ্বাসে এই কথাটা বলল।

“আপনাকে দেখে মনে হয় কেমন যেন পালাতে চাইছেন আমার থেকে? কথাই বলেন না'

“তাই নাকি? কিন্তু আন্টি যে বলল, আপনি নাকি আগে অনেক কথা বলতেন, এখন আর বলেন না?

ছি! এসব কি বলছ? তোমাকে করুণা করবো কেন আমি? "আমি কথা বার্তাই কম বলি অতসী, ছোট থেকেই এমন।" "মা বুঝি এসব বলে তোমাকে? হা হা হা! বানিয়ে বানিয়ে বলে সে, এসব কানে নিও। না।' "আমাকে এসব না বললেও হবে। উনার ছেলেকে আমি এবনরমালই ভাবি।”

“ওমা! কোন মা বুঝি নিজের ছেলেকে নিয়ে মিথ্যে বলে? -

"আমার মা বলে, তোমাকে খুশি করতে, যেন তুমি তার ছেলেকে এবনরমাল না ভাবো।

"কি বললা তুমি? জানো আমি তোমার চেয়ে কত বড়?”
"জানি, কিন্তু আমার তাতে প্রব্লেম নেই। আমাদের আকদের দিন তো এসেই পড়ল, চলুন না কাল একটু বের হই, আমি একটা শাড়ি কিনব, আপনি পছন্দ করে দিবেন।”

“আর একদিন হবে অতসী, কাল অফিসে মিটিং আছে, দেরি হবে আসতে, আর একদিন হবে, কেমন?”

"আচ্ছা। আপনার নাকি অনেক পুরনো একটা ভেসপা আছে? অনেক পছন্দের?

আমাকে চড়াবেন সেটাতে?”

“ধুর! এই যুগে কেউ ভেসপা চালায় নাকি? আর তোমার ভালোও লাগবে না ঐটা। আচ্ছা রাখছি, কাজ করবো।

""আচ্ছা" - এই বলে সে ফোন রেখে দিল কিন্তু আমি যেন মেয়েটার অভিমানটা টের

পেলাম পুরোপুরি। আমার কি তাকে ফোন দেয়া উচিত এক্ষুনি?

নাহ! আমাকে দিয়ে আর হচ্ছে না। আমার ভেতর টা পুরোপুরি মরে গেছে। কারো জন্য সেটা হয়তো আর কখনও জেগে উঠবে না। এই বিয়ে হলেও আমরা কেউ সুখি হতে পারব না। কাউকে সুখি করার ক্ষমতা নেই আর আমার। অতসী মেয়েটা জীবনে একবার কষ্ট পেয়েছে, আমি আবার তাকে কষ্ট দিতে পারি না। কিন্তু কি করবো আমি? কিই বা করার আছে আমার ?





পরদিন অফিসে মিটিং টা হুট করেই ক্যান্সেল হয়ে গেল। কাজ তেমন ছিল না, বসে বসে ঝিমাচ্ছিলাম। এই সময় প্রবল বৃষ্টি শুরু হল। জ্যৈষ্ঠের শেষ, বর্ষা আসি আসি করছে। এ তারই বহিঃপ্রকাশ। আমি কফি আর সিগারেট হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। এই সিগারেট যাওয়াটা আর ছাড়তে পারলাম না। কত ভেবেছি ছেড়ে দিব কিন্তু হয়ে উঠে না। কি করবো? এটা যে তার স্মৃতি ভুলে থাকতে টনিক হিসেবে কাজ করে। বৃষ্টির ছাঁচ এসে গাঁ ভিজিয়ে দিচ্ছে, তাও আমি সরে গেলাম না। ভালই লাগছিল। পরমার বৃষ্টি অনেক পছন্দ ছিল। বৃষ্টি দেখলেই বাচ্চাদের মত ভিজতে নেমে পড়তো। তারপর সর্দি কাশি লাগিয়ে অবস্থা খারাপ করে ফেলত। আমাদের বিচ্ছেদের দিন ও ঠিক এমন ঝুম বৃষ্টি ছিল। আমি ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেলাম।

৬ বছর ৪ মাস ২১ দিনের দিন ভোরে পরমার হটাৎ সেই ফোন পেয়ে আমি তখন হতভম্ব। অপর প্রান্তে সে অনেক আগেই রেখে দিয়েছে। আমি বোকার মত হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছিলাম। যখন বুঝতে পারলাম সাথে সাথেই তাকে ফোন দিলাম। তার ফোন বন্ধ। আমার কলজেটা যেন কেউ খামছে ধরেছে। আমি ফোন দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু অফ পাচ্ছি বার বারই।

আমি ভোর না হতেই বাসা থেকে বের হয়ে সোজা পরমার বাসার দিকে চললাম। তাড়াহুড়ায় ভেসপাটা নিতে ভুলে গেছিলাম সেদিন। তার বাসায় তো আমি আগে একবার গেছিই। আন্টি আমাকে পছন্দ করে না জেনেও ভাবলাম উনাকে শেষ একবার বুঝাবার চেষ্টা করবো। তাদের বাসায় এসে দেখি তালা ঝুলানো। কেউ নেই। ফাঁকা। তার এক বন্ধুর বাসা ছিল কাছেই। আমি সেখানে গেলাম। তার বন্ধুটা আমাদের সব কিছুই জানত।

“ভাইয়া, এতো সকালে আপনি?” দরজা খুলে ঘুম ঘুম গলায় বলল মেয়েটা। "পরমারা কোথায় গেছে বলতে পারবে?”

*ওরা বাসায় নেই? আমাকে তো কিছুই বলে নি ভাইয়া। ভেতরে আসুন।”

“নাহ ভেতরে যাব না। সে কি তোমাকে কিছু বলেছে দুই একদিনের ভেতর আমাদের ব্যাপারে?"

দুই দিন আগে কথা হয়েছিল। আপনাদের নাকি ঝগড়া হয়েছে? আমাকে বলল, সে আর সম্পর্ক রাখতে পারছে না। তার মা ও নাকি চায় না আপনার সাথে সে কথা বলুক।"

আমি এটা শুনে দৌড়ে বের হয়ে আসলাম তার বাসা থেকো অফিসের সময় হয়ে গেছে ততক্ষণে। ঢাকায় পরমার অনেক আত্মীয় স্বজন, ওরা কি সেখানে কোথাও গেছে? আমি অফিসে না যেয়ে সেখানে কোথাও যাব ঠিক করলাম। তার মামার বাসা চিনতাম। আকাশে রোদ নেই, মেঘের ঘনঘটা, কেমন গুমোট হয়ে আছে। আমার কাছে পরমার মায়ের নাম্বার ছিল। কিন্তু তার ফ্রেন্ড যা বলল তারপরও কি আন্টিকে ফোন দেয়া উচিত হবে? কিন্তু আমার তখন পাগল প্রায় অবস্থা। পরমার নাম্বার এখনও বন্ধ। আমি আন্টিকে ফোন দিলাম, বিং হচ্ছে তাপর প্রান্তে, কিন্তু কেউ ধরছে না। আমি দিতেই থাকলাম।

অবশেষে অনেকক্ষণ রিং হবার পর উনি ফোন ধরলেন। আন্টি আমি অরিত্র, ভালো

আছেন? আমি আমতা আমতা করে বললাম। উনি শুকনো গলায় বললেন, বুঝতে পেরেছি। কেমন আছো? "জী আন্টি, ভালো পরমা কেমন আছে? ওকে ফোনে পাচ্ছি না, তাই আপনাকে

ফোন দিলাম, ওর শরীর খারাপ করে নি তো আন্টি?

"ওর কথা আর ভাবতে হবে না তোমাকে। প্লিজ আমার মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না।"
“কি বলছেন এসব আন্টি? আমি তাকে কষ্ট দেই?"- আমি বিমূর্তের মত বললাম ।

"ওর কথা আর ভাবতে হবে না তোমাকে। প্লিজ আমার মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও

হ্যাঁ! কষ্ট দাও। আজকের পর থেকে আমার মেয়ের সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা

করবে না।"

আন্টি প্লিজ, আমি একটু পরমার সাথে কথা বলতে চাই, ওকে একটু ফোনটা

দিবেন?”- আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম।

ও তোমার সাথে আর কথা বলতে চায় না। আর আজকে ওর বিয়ে, ওকে বিরক্ত করবে না আর। তোমার যন্ত্রণায় আত্মীয়ের বাসায় মেয়ের বিয়ে দিতে হচ্ছে।"- এই বলে উনি ফোনটা কেটে দিলেন।

"বিয়ে?"

আমি যেন জমে গেলাম নিমিষেই। ফোনটা এখনও কানেই ধরে আছি। আশেপাশের

সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে গেল। ঠিক এই সময় ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামলো।

আমি সেই ঝুম বৃষ্টিতে উদ্দেশহীন ভাবে এদিক সেদিক ঘুরলাম। বাসা থেকে মা ফোন

দিল, ধরি নি। আমি বনানী থেকে হেঁটে হেঁটে রামপুরা গেলাম। ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগছে। মাত্র ৪ দিনের মাঝে তুমি বিয়েতে বসে গেলে? কিভাবে পারলে? এতো দিনের সম্পর্ক কয়েক মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারলে? এতো কঠিন তুমি? আমি ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসব ভাবছিলাম। চোখের পানি বৃষ্টির পানির সাথে

মিশে যাচ্ছে। আশে পাশের কেউ কি বুঝতে পারছে আমার ভেতরে কত ভাঙ্গা গড়ার

খেলা চলছে? এই সময় একটা বাস পিছন থেকে এসে হর্ন দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে প্রায় আমার গায়ের উপর এসে ব্রেক চাপল। কখন যে ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় নেমে গেছি নিজেই জানি না। মনে মনে কি সুইসাইড করতে চাচ্ছি আমি? বাসের হেল্পার প্রচণ্ড খারাপ একটা গালি দিল আমার উদ্দেশ্যে। আমি কোন ভ্রূক্ষেপই করলাম না। কিছুক্ষণ পর একটা বাসে চড়ে বসলাম। নিজেকে কীট পতঙ্গের চেয়েও ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল।

বাবা আমি অসুস্থ, আমার কেউ নেই, দুইদিন ধরে কিছু খেতে পাই না, এই অসহায়কে কেউ একটু সাহায্য করুন।"- একটা বয়স্ক লোকের কণ্ঠ শুনে আমি যেন স্তম্ভিত ফিরে পেলাম।

আমার হটাৎ হাসি পেল! প্রচণ্ড হাসি। লোকটার কেউ নেই তাই সে অসহায় আর আমার সব কিছু আছে শুধু একজন মানুষ নেই তাও নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নিঃস্ব আর অসহায় মনে হচ্ছে। আমি আমার ওয়ালেটটা উনার হাতে ধরিয়ে দিলাম। লোকটা আমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকালো। আমার জন্য শুধু একটু দোয়া করবেন।" আমি চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে নেমে গেলাম। ওয়ালেটে টাকা পয়সা ছাড়াও পরমার কয়েকটা ছবি ছিল। আর ছবি। মানুষটাই নেই আর ছবি দিয়ে কি হবে?

তারপর দীর্ঘ ৬ টি বছর পার হয়েছে। আমার এখনও মনে হয় মাত্র সেদিনের ঘটনা। কিন্তু কতকিছু বদলে গেছে এর মাঝে। আমি চেইন স্মোকারে পরিণত হয়েছি, কয়েকটা চাকরি বদলে এখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে থিতু হয়েছি, রাগ করে ভেসপাতে আর কখনও চড়া হয় নি। বাবার মাইনর একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে, চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করেছে, বিয়ে করার জন্য মায়ের জোরাজুরি সমানুপাতিক হারে বেড়েছে, তোমরা তোমাদের পুরনো বাড়িটা বেঁচে কোথায় চলে গেছো কে জানে? তোমার বিয়ের পর ও অফিস শেষে নিয়ম করে প্রতি সন্ধ্যায় তোমাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতাম শুধু একবার তোমাকে দেখতে। তখন কি আর জানতাম যে তুমি বিয়ের দিনই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পাড়ি জমিয়েছ তোমার প্রবাসী স্বামীর সাথে। পরে যখন তোমার সেই ফ্রেন্ডের কাছে জানতে পারলাম এসব তারপর আর দাঁড়াই নি। তোমার হয়তো অনেক আগে থেকেই প্লান ছিল আমাকে ছেড়ে যাবার, তাই না?
আমি কত বোকা, কখনও বিন্দুমাত্র বুঝতেও পারি নি কিছু। কিন্তু জানো? আমার কিন্তু সব সময় মনে হত আমি তোমাকে কখনও পাবো না। এই ভয় মনের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। তাই সব সময় তোমাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভয়টাই সত্যি হয়ে গেল। তুমি সব ভুলে গেছো হয়তো কিন্তু আমি পারছি না। তোমার স্মৃতি কাঁটার মত এখনও জড়িয়ে আছে আমাকে, অহর্নিশি সেগুলো আমাকে ক্ষত বিক্ষত করে। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করি কিন্তু কাউকে বুঝতে দেই না ।


পরিশিষ্ট

আজকে আমার আকদ। ভোর চারটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল। বাসায় আত্মীয় স্বজন গিসসিস করছে। অনেক রাত পর্যন্ত হই হুল্লুড় করে সবাই দেরীতে ঘুমুতে গেছে, এতো সকালে কেউ এখনও উঠে নি। আমি চুপচাপ ছাদে উঠে একটা সিগারেট ধরালাম। ভোরের আলো ফোটে উঠতে শুরু করে নি। ঐ তো আকাশের কোণে এখনও শুকতারাটাকে দেখা যাচ্ছে। ঐ বেচারাকেও আমার মত বড্ড একা মনে হয়। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি একা একা জ্বলে যাচ্ছে প্রতি নিয়ত। আর একা একাই হয়তো জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে একদিন।

কাল রাতে ইচ্ছে করেই দেরি করে বাসায় ফিরেছি যেন আকদের কোন কিছু আমাকে করতে না হয়। মা অবশ্য অনেকবার ফোন দিয়েছিল কিন্তু ইচ্ছা করেই ধরি নি। সিগারেট খেতে খেতেই মনস্থির করে ফেললাম কি করবো। একটা সুখ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম সেটাকে ছাদের কিনারে। জীবনের শেষ সিগারেট ছিল এটা। আর কখনও স্পর্শ ও করবো না। আমি পারলাম না, প্লিজ ক্ষমা করে দিও।-- অতসীকে টেক্সট করলাম। বেচারি নিশ্চই নতুন স্বপ্নে বিভর হয়ে ঘুমাচ্ছে।

"আমি জীবনের প্রতি হতাশ, ত্যক্ত, বিরক্ত। বাবা মা হয়েও এক মাত্র ছেলের এই ব্যাপার গুলো বুঝতে চাও নি। বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গেছিলে তোমরা। বিয়েটাই জীবনের সবকিছু না। আমি মনে করি আমার জীবনে আরও অনেক কিছু করার আছে, পাওয়ার আছে আর আমি সেটা করতে চাই, পেতে চাই। হয়তো কখনও বিয়েও করতে চাইব কিন্তু সেটা এখনই না। ভেবো না, করলে তোমাদের পছন্দমতই করবো। আমি চলে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি আপাতত জানা নেই। প্লিজ, আমাকে খোঁজার চেষ্টা করো না, করলে সেটা যে শুধু আমার রাগ আর বিরক্তিই বাড়াবে তা তোমরা জানো। আর দোয়া করো আমার জন্য।


পুনশ্চ- ব্যাংকের কাগজপত্র সব রেখে গেলাম। একটু দেখলেই বুঝবে। আর বড়মামা তো আছেই। উনি সব দেখবেন।"

চিঠিটা আগেই লিখা ছিল। ছাদ থেকে চুপচাপ নেমে মা বাবার ঘরে ঢুকে চিঠি, আমার ব্যাঙ্কের কাগজ আর ভিসাকার্ডটা বাবার টেবিলে রাখলাম। শেষবারের মত মা বাবার মুখের দিকে তাকালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস নিজের অজান্তেই বেরিয়ে গেল বুক চিরে। নাহ! মায়া কাটাতে হবে। আমি নিঃশব্দেই আবার বেরিয়ে গেলাম। গ্যারেজে যেয়ে ভেসপাটাকে কোন শব্দ না করে ঠেলে ঠেলে বের করলাম। কয়েকদিন আগেই এটাকে ধুয়ে মুছে, তেল ভরিয়ে রেডি করে রেখেছিলাম আজকের জন্য। বাসা থেকে বেরিয়ে অনেকটা দূরে এসে ভেসপাতে উঠলাম। কোথায় যাবো এখনও ঠিক করি নি। পকেটে দুই একদিন চলার মত টাকা আছে। তারপর? তারপর দরকার পড়লে ভেসপাটা বিক্রি করে দিব। মায়া যখন কাটাচ্ছি তখন সব কিছুর উপর থেকেই কাটানো উচিত। আর না হলে একটা না একটা উপায় বের হবেই। কতদিনের ইচ্ছা ছিল একদিন নিরুদ্দেশ যাত্রা করবো। অবশেষে আজ, সেটা হয়েই গেল। আচ্ছা, আমি কি দুর্বল, কাপুরুষ নাকি পাগল? নাকি দায়িত্বের ভয়ে পালাচ্ছি? হয়তো আমি সবই। আসলে একটা মানুষের সাথে থাকার চেয়ে তার স্মৃতি নিয়ে থাকাটা অনেক বেশি কষ্টের। এই শহরের প্রতিটা অলি গলি আনাচে কানাচে পরমার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। আর গত ৬ টি বছর ধরে সেই স্মৃতি আমাকে দিন রাত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। পালানো ছাড়া সেগুলো থেকে আর মুক্তির উপায় নেই।

থাক। আর ভাববো না। আজ থেকে আমার কোন অতীত নেই, কোন স্মৃতি নেই। আজ থেকে পিছনে পড়ে থাক আমার সব সংকীর্ণতা, সব জরাজীর্ণতা। শুরু হোক নিরুদ্দেশ যাত্রা। একদিন হয়তো ফিরে আসবো, নতুন মানুষ হয়ে। হয়তো..
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
বিষণ্ন সুমন অভিনন্দন ও ভালোবাসা রইলো
মোঃ মোখলেছুর রহমান আন্তরিক অভিনন্দন।
মোঃ মোখলেছুর রহমান বিষয় ও গাঁথুনি বেশ
ভালো লাগেনি ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
আপনার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, ভালো লেগেছে শুনে ভালো লাগলো ।
ভালো লাগেনি ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
ফয়জুল মহী খুবই সুন্দর উপস্থাপন মুগ্ধ হলাম
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার জন্য।
ভালো লাগেনি ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
Shammi Hossain ভালো লেগেছে গল্পটা
ভালো লাগেনি ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
ধন্যবাদ আপনাকে

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার মত কষ্ট আর কিছুতে কি আছে??

২৩ জানুয়ারী - ২০২৩ গল্প/কবিতা: ১ টি

সমন্বিত স্কোর

৫.০৮

বিচারক স্কোরঃ ২.৬৮ / ৭.০ পাঠক স্কোরঃ ২.৪ / ৩.০

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪